নবাবপুর পার হয়ে বাহাদুর শাহ্ পার্ক পেরিয়ে বাংলাবাজার। সেখান থেকে একটু এগিয়ে বাঁয়ে মোড় নিলে প্যারিদাস রোড। এই রোডের পাশেই শ্রীশদাস লেন। আর এই লেনের ১ নম্বর বাড়িটিই বিউটি বোর্ডিং। যেখানে থাকাও যায়, আবার দুপুর বা রাতে খাওয়াও যায়।
প্রথম দেখাতে এটি আপনাকে খুব একটা আকৃষ্ট নাও করতে পারে। প্রধান ফটকটা ঘষেমেজে একটু সময়োপযোগী করা হয়েছে। সেটা দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়বে পুরানা একটি দোতলা বাড়ি। হলুদ বর্ণের প্রাচীন আমলের গাঁথুনি মুহূর্তেই আপনাকে নিয়ে যাবে একশ বছর পেছনে।
মাঝখানে প্রশস্ত উঠোন। ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা। বেশ আড্ডার জায়গা। পাশে খাবারঘর, শোবারঘর, পেছনে সিঁড়িঘর সবই গল্পের বইয়ে লেখা প্রাচীন জমিদারবাড়ির বর্ণনার মতো।
বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান মালিক তারক সাহাও জানালেন সেই কথা। আসলেই এটা একটা জমিদারবাড়ি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় জামিদার পরিবারটি ভারতে চলে যায়। তখন এখানে গড়ে ওঠে একটি ছাপাখানা। সে সময় এখান থেকেই প্রকাশিত হত সোনার বাংলা নামের একটি পত্রিকা। দেশভাগের পর বাংলাবাজার হয়ে ওঠে প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। তখন থেকেই বিউটি বোর্ডিং শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হয়ে যায়। একসময় সোনার বাংলা পত্রিকাটির অফিস কলকাতায় চলে গেলে এর মালিক সুধীরচন্দ্র দাসের কাছ থেকে জায়গাটা বুঝে নেন প্রহ্লাদচন্দ্র সাহা ও তার ভাই নলিনীকান্ত সাহা। তারপর সোনার বাংলা প্রেসের জায়গায় শুরু হয় আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁর ব্যবসা।তারক সাহা বলেন, “এ জায়গাটি ছিল বাংলা সাহিত্য-সংস্কৄতির গুণী মানুষদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। সমমনা মানুষদের নির্জলা আড্ডা চলত দিনরাত।”
চল্লিশের দশকে এই আড্ডা পুরান ঢাকায় সুখ্যাতি লাভ করে। কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেক বিখ্যাত মানুষ এখানে আসতেন। আবদুল জব্বার খান এখানে বসেই লেখেন বাংলার প্রথম সবাক ছবি মুখ ও মুখোশের পাণ্ডুলিপি। সমর দাস বহু গানের সুর তৈরি করেছেন এখানে বসে। শামসুর রাহমান লিখেছেন- মনে পড়ে একদা যেতাম প্রত্যহ দুবেলা বাংলা বাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই বিউটি বোর্ডিং-এ পরষ্পর মুখ দেখার আশায় আমরা কজন।
এছাড়াও আড্ডায় আসতেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, ফজলে লোহানী। আসতেন কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দোপাধ্যায়ও। সত্য সাহা, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কলামলেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী, ভাস্কর নিতুন কুণ্ডু, কবি আল মাহমুদ, শহিদ কাদরী প্রমুখ। ঐতিহাসিক বিউটি বোর্ডিংয়ে থেকেছেন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ।
১৯৭১ সালে সেই আড্ডায় ছেদ পড়ে। পাকহানাদারবাহিনী জেনে যায় বাঙালির এই সাহিত্যসংস্কৃতির মানুষদের মিলনমেলার কথা। ২৮ মার্চ এখানেই শহিদ হন প্রহ্লাদ সাহাসহ আরও ১৭ জন।
ভুঁড়িভোজের আশায় এসে এত কিছু জানব তা কল্পনাও করা যায়নি। যাহোক, সাহিত্যের তীর্থক্ষেত্রের খাবার ঘরে ঢুকলেই চোখে পড়বে সারি সারি টেবিল-চেয়ার। প্রতিটিতে স্টিলের বড় থালা আর গ্লাস রাখা। তারক সাহা জানান একসময় এখানে পিঁড়িতে বসে মেঝেতে থালা রেখে খাওয়া হত।
খাবারঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে প্রাচীন আড্ডার কয়েকটি ছবি। হঠাৎ করেই শিহরণ জাগবে এই ভেবে একসময় যে ঘরে খেয়ে গেছেন বহু গুণী মানুষ, আজ সেখানে আপনিও বসেছেন পেট পূজাতে।
তবে শিহরণ হারিয়ে যাবে সরষে ইলিশের ঘ্রাণে। জিহবায় পানি চলে আসবে মুহূর্তেই। খাবারের তালিকায় চোখ বুলালে পাবেন আরও অনেক পদ।
খিচুড়ি ৩০ টাকা। মুরগির মাংস ৫০ টাকা। খাসির মাংস ৮০ টাকা। সবজি ১০ টাকা। বড়া ১০ টাকা। চচ্চড়ি ১০ টাকা। পোলাও ৫০ টাকা। মুড়িঘণ্ট ৫০ টাকা।
এছাড়া বাইলা, কাতলা, রুই, তেলাপিয়া, চিতল, পাবদা, ফলি, সরপুটি, শিং, কৈ, মাগুর, ভাংনা, চিংড়ি, চান্দা, আইড়, বোয়াল, কোড়ালসহ প্রায় সব ধরনের মাছ পাবেন এখানে।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, বছরের যে কোনো সময় যে কোনো দিন সরষে ইলিশ খেয়ে যেতে পারবেন এখান থেকে। তবে সেটা অনেকখানি নির্ভর করবেন বাজারে ইলিশের প্রাপ্যতার উপর।
সকালের নাস্তা ২০ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে, দুপুর ও রাতের খাবার ৫০ থেকে ৬০ টাকা হলে যথেষ্ট। তবে সরষে ইলিশ খেতে ১০০ টাকা গুনতে হবে।দুপুর বেলা খেয়ে বিকেল বেলা খুব সহজেই ঘুরে আসতে পারেন ঐতিহাসিক আহসানমঞ্জিল ও সদরঘাট। দুটো জায়গা বিউটি বোর্ডিং থেকে বেশি দূরে নয়। আহসানমঞ্জিলের প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা।
বিউটি বোর্ডিংয়ে এখনও থাকার ব্যবস্থা আছে। রয়েছে ২৫টি কক্ষ। এক বিছানায়ালা রয়েছে ১২টি কক্ষ, এক রাতের জন্য ভাড়া ২০০ টাকা। বাকিগুলো দুই বিছানায়ালা কক্ষ, ভাড়া ৩০০ টাকা।
পৌঁছবেন যেভাবে
ঢাকার যে কোনো স্থান থেকে গুলিস্তানে আসতে হবে। এখান থেকে বাসে চড়ে ৫ টাকায় অথবা রিকশায় ২০ টাকায় বাহাদুর শাহ ভিক্টোরিয়া পার্ক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে যে কাউকেই জিজ্ঞেস করল দেখিয়ে দেবে বিউটি বোর্ডিং।