Blog

July 17, 2013

বোর্ডিং আছে, বিউটি নেই

পুরান ঢাকার যানজট মাড়িয়ে বাংলাবাজারে ঢুকেই শ্রীশ দাস লেন, একটু মোড় নিলেই চোখে পড়বে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ফিকে হলুদ রঙের একটি দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে প্রশস্ত উঠোন। শ্যামল-সবুজে ঘেরা। একেবারে আড্ডার উপযোগী জায়গা। পাশে খাবার ঘর, শোবার ঘর, পেছনে সিঁড়িঘর_ সবই পুরনো বাড়ির রূপকথার গল্পের মতো সাজানো। এই বিউটি বোর্ডিং বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র বা ইতিহাসের ভিত্তিভূমি। যেন একটি জ্যান্ত ইতিহাস সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিউটি বোর্ডিং ও এর আড্ডার ইতিহাস চলি্লশের দশক থেকেই সুখ্যাতি লাভ করেছিল। সমমনা লোকদের তখন বিভিন্ন বিষয়ে চলত তোলপাড় করা সব আড্ডা। অনেক কবি-সাহিত্যিকেরই এভাবে লেখা তৈরির বহু ইতিহাস রয়েছে এই বিউটি বোর্ডিংয়ে।

এক সময় বিউটি বোর্ডিংয়ের জায়গায় একটি প্রেস ছিল। নাম ছিল ‘সোনার বাংলা’। ওই প্রেস থেকে ‘সোনার বাংলা’ নামে একটি পত্রিকাও বের হতো। ক্যালেন্ডারে যখন ১৯৪৮, তখন জন্ম নেয় নতুন দুটি দেশ। দেশ ভাগের পর সোনার বাংলা প্রেস কলকাতা চলে যায়। প্রেসের মালিক ছিলেন তখন জমিদার সুধির চন্দ্র দাস। ১৯৪৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রহ্লাদ সাহা ও নলিনী মোহন সাহা দুই সহোদর মিলে তৎকালীন জমিদার সুধির চন্দ্র দাসের কাছ থেকে এ জায়গাটুকু নিয়ে নেন। প্রহ্লাদ সাহা তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের ফাড়িংবাজার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার তামাক পাতার ব্যবসা ছিল। বড় ভাই নলিনী মোহন সাহার সঙ্গে তামাক পাতার ব্যবসা শুরু করেন প্রথম জীবনে। বাংলাবাজারে প্যারীদাস রোডে দুই সহোদর মিলে তৎকালীন জমিদার সুধির চন্দ্র দাসের কাছ থেকে এ জায়গাটুকু নিয়ে গড়ে তোলেন আজকের বিউটি বোর্ডিং।

বিউটি বোর্ডিংয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অজস্র কারণ ছিল। জন্মলগ্ন থেকেই এখানে আড্ডা দিতেন এ দেশের প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্র পরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক সভা করেছেন, দিয়েছেন বিভিন্ন দিকনির্দেশনা। তবে এখানকার জমজমাট আড্ডার প্রাণপুরুষ ছিলেন কবি শহীদ কাদরী ও বেলাল চৌধুরী। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় এই বিউটি বোর্ডিং হয়ে ওঠে দেশের শিল্প-সাহিত্যের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। দেশবরেণ্য কবি শামসুর রাহমান, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক এখানে বসে সকাল-সন্ধ্যা আড্ডা দিতেন এবং জন্ম দিতেন তাদের বিখ্যাত সব লেখার।

সেই তুমুল আড্ডায় ছেদ পড়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি আর্মিরা খবর পায় বিউটি বোর্ডিং বাংলাদেশের মেধাবীদের সর্ববৃহৎ আড্ডাস্থল। ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিং ঘিরে ফেলা হয় এবং মালিক প্রহ্লাদ সাহা, বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার-বোর্ডারসহ প্রায় ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।

দেশ স্বাধীন হয়। শহীদ প্রহ্লাদ সাহার স্ত্রী তার দুই ছেলে তারক সাহা ও সমর সাহাকে নিয়ে চালু করেন বিউটি বোর্ডিং। তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বিউটি বোর্ডিং। কিন্তু সেই ঐতিহ্য ততদিনে হারিয়ে যায়।

এখনও বিউটি বোর্ডিং আছে। আছে ২৪টি কক্ষ। এর মধ্যে সিঙ্গেল কক্ষ ৮টি। ডাবল কক্ষ রয়েছে ১৫টি। তিনবেলাই খাবারের ব্যবস্থা আছে। এখনও বোর্ডার কিংবা বাইরের লোকজন অনেকে শখ করে দূর থেকে আসে কালের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিংয়ে। বিউটি বোর্ডিংয়ের সঙ্গে মিশে থাকা মানুষগুলো নামটি শুনে এখনও হয়তো আবেগতাড়িত হন, ভোগেন নস্টালজিয়ায়।

উপপরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সমকাল

 

samakal
About বিউটি বোর্ডিং

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *