১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় পরিকল্পিত গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। যার মাধ্যমে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব বড় শহর দখল করে নেয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। বাঙালির সবচেয়ে গৌরবময় ইতিহাস ১৯৭১। আর এই ৭১-এর সবচেয়ে বেদনাদায়ক স্মৃতি হলো পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরোচিত, পৈশাচিক গণহত্যা। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের অনেক নির্মমতা-নৃশংসতাই আমাদের এখনো অজানা। দেশের বিভিন্ন জনপদ ঘুরে নিবিড় অনুসন্ধানের মাধ্যমে গণহত্যার নানা ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক
বিশ্বের অনেক দেশেই এমন অনেক হোটেল বা রেস্টুরেন্ট আছে যেগুলো বিখ্যাত লেখক আর শিল্পীদের আড্ডার স্থল হিসেবে পরিচিত। তেমনই একটি স্থান ঢাকার বাংলাবাজারের শ্রীশ দাশ লেনের ১ নম্বর বাড়ির বিউটি বোর্ডিং। আনুমানিক সাড়ে ৯ কাঠা আয়তনের এই স্থানে প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা বিউটি বোর্ডিং প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৪৯ সালে, কারো কারোর মতে ১৯৫৩ সালে। স্বল্পব্যয়ে আবাস, আশ্রয় ও আড্ডার স্থল হিসেবে তিনি শিক্ষিত, কর্মসন্ধানী ও সংস্কৃতি বোধবুদ্ধিসম্পন্ন যুবকদের জন্য বিউটি বোর্ডিং প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে বিউটি বোর্ডিং নির্মিত হয় তা ছিল একজন জমিদারের। নিঃসন্তান জমিদারের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী সেই জায়গার মালিক হন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এখানে ‘সোনার বাংলা প্রেস’ ছিল এবং এখান থেকে সাপ্তাহিক সোনার বাংলা নামে একটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা প্রকাশিত হতো। তৎকালীন এই পত্রিকায় এদেশের স্বনামধন্য লেখকদের অনেকেরই প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কবি শামসুর রহমান, লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার অন্তরালে এখানে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিপ্লবী কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
১৯৪৮ সালের পরে সোনার বাংলা প্রেসের মালিক বাংলাবাজার এলাকার জমিদার সুধীর চন্দ্র দাশ কলকাতায় তার প্রেস স্থানান্তর করেন। ৪৮, নর্থব্রুক হল রোডে তার বাড়ি ছিল। ১৯৪৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে মুন্সিগঞ্জের প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা সুধীর চন্দ্র দাশের কাছ থেকে জায়গাটি কিনে নেন। বুড়িগঙ্গা নদীর কাছে স্নিগ্ধ পরিবেশে প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা বিউটি বোর্ডিং নির্মাণ করেন। সেখানে সুলভমূল্যে ঘর ভাড়া দেয়া হতো এবং সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশে স্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করা হতো। শুরুতে বোর্ডিংয়ের বেড ভাড়া ছিল ২-৩ টাকা আর খাবার মূল্য ছিল মাত্র ১ টাকা।
ঢাকা শহরের অনেক তরুণ সাহিত্যকর্মী তখন বিউটি বোর্ডিংয়ের আশপাশের এলাকায় বাস করতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, কায়সুল হক, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ফতেহ লোহানী প্রমুখ। তারা প্রায়ই সেখানে এসে সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করতেন। তাদের সঙ্গে আরও যোগ দিতেন হাসান হাফিজুর রহমান, খালেদ চৌধুরী, ফজলে লোহানী, সমুদ্র গুপ্ত, মিজানুর রহমান, মোহাম্মদ রফিক, ব্রজেন দাশ, রফিকুন নবী, জিয়া আনসারী, আহমদ ছফা, নির্মলেন্দু গুণ, আল মাহমুদ, আনিসুজ্জামান, মুনতাসীর মামুন, মহাদেব সাহা, ওবায়দুল্লাহ খান প্রমুখ। জানা যায় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিউটি বোর্ডিংয়ে এসেছেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব ছাড়াও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতারা প্রায়ই বিউটি বোর্ডিংয়ে আসতেন। প্রতিটি শ্রেণি ও পেশার মানুষ তথা ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, গায়ক, অভিনেতা, নৃত্যশিল্পী, রাজনীতিক, ভবঘুরে, আড্ডাবাজ, ব্যবসায়ী এবং সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীর আগমনে মুখর থাকত বিউটি বোর্ডিং।
১৯৫০ সাল থেকে বাংলাবাজারে বই প্রকাশনা শিল্প গড়ে উঠতে থাকে। ফলে বাংলাবাজার সংলগ্ন বিউটি বোর্ডিংয়ে শিল্পী, সাহিত্যিকদের আগমন বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিউটি বোর্ডিংয়ের সবুজ খোলা চত্বরেই আড্ডা জমত বেশি। বোর্ডিংয়ের মালিক প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহার আন্তরিকতার জন্যই এই স্থানটির প্রতি মানুষের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তাই প্রহ্লাদ বাবুর বিউটি বোর্ডিং দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির পদচারণায় ধন্য হয়েছে। বিউটি বোর্ডিংকে কলকাতার কফি হাউজের সাথে তুলনা করা হতো।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি চর্চা কেন্দ্র বিউটি বোর্ডিংয়ে আঘাত হানে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে যখন ঢাকা শহরে গণহত্যা শুরু হয়েছে তখন বোর্ডিংয়ের মালিক প্রহ্লাদ বাবু তার নিকটজনদেরকে বলেন: “শহরের অবস্থা শোচনীয়, তাই দ্রুত আমাদেরকে দূরে কোথাও আশ্রয় নিতে হবে।” ২৭শে মার্চ সকাল পর্যন্ত তিনি বোর্ডিংয়ের কাছেই তার আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। ২৮শে মার্চ সকালের দিকে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে তিনি বোর্ডিংয়ে আসেন। বোর্ডার ও স্টাফদেরকে বোর্ডিং ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার জন্য উপদেশ দেয়া এবং বোর্ডিং তালাবন্ধ করে দেয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। পথে আসার সময় তার কয়েকজন বন্ধু তার সঙ্গে বোর্ডিংয়ে আসেন। প্রহ্লাদ বাবু একজন প্রগতিশীল ব্যক্তি এবং তার বোর্ডিংয়ে স্বাধীনতাকামীদের যাতায়াত ছিল বলেই তিনি বোর্ডিংয়ে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় দোসররা তাদেরকে খবর দেয়। বোর্ডিংয়ে তখন মোট ১৮ জন মানুষ ছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা বোর্ডিং ঘেরাও করে ১৮ জনকে সবুজ চত্বরে লাইন করে দাঁড় করায় এবং মুহূর্তেই তাদের ওপর গুলি চালানো হয়। বিকট শব্দ ও মানুষের চিৎকার, তারপরেই চারদিকে সব চুপচাপ! ১৮ জনের মৃতদেহ তারা ছুড়ে ছুড়ে একটি ট্রাকে তুলে নেয়। পরবর্তীকালে তাদের আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত অবস্থায় নেপাল চন্দ্র দাশ পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে তিনি চিকিৎসার পর নিহতদের পরিবারের কাছে এসে সেদিনের গণহত্যার বিবরণ দেন।
সেদিনের গণহত্যায় শহিদ ১৭ জনের মধ্যে ছিলেন ১৪ জন হিন্দু, ২ জন মুসলমান ও ১ জন খ্রিস্টান। তাদের নাম নি¤েœ উল্লেখ করা হলো:
১. শহিদ প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা (বিউটি বোর্ডিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা)
২. শহিদ সন্তোষ কুমার দাশ (ব্যবসায়ী ও প্রতিবেশী)
৩. শহিদ হেমন্ত কুমার সাহা (প্রকাশক)
৪. শহিদ অহীন্দ্র চৌধুরী শংকর (ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব)
৫. শহিদ প্রভাত চন্দ্র সাহা (শিক্ষক)
৬. শহিদ নির্মল রায় খোকা বাবু (সমাজসেবক)
৭. শহিদ হারাধন বর্মন (চিত্রশিল্পী)
৮. শহিদ প্রেমলাল সাহা (ব্যবসায়ী/বোর্ডার)
৯. শহিদ কেশব দেও আগারওয়াল (ব্যবসায়ী/বোর্ডার)
১০. শহিদ শামস্ ইরানী (চলচ্চিত্র শিল্পী)
১১. শহিদ জোসেফ (অভিনেতা)
১২. শহিদ শীতল কুমার দাশ (বিউটি বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার)
১৩. শহিদ অখিল চক্রবর্তী (বিউটি বোর্ডিংয়ের পাচক)
১৪. শহিদ সাধন চন্দ্র রায় (স্টাফ)
১৫. শহিদ সুখরঞ্জন দে (স্টাফ)
১৬. শহিদ ক্ষিতীশ চন্দ্র দে (স্টাফ)
১৭. শহিদ নুর মো. মোল্লা (স্টাফ/প্রতিবেশী)।
বিউটি বোর্ডিংয়ের শহিদদের স্মরণে বাংলাবাজারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, তবে সেখানে তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়নি।